[>>] মেজদিদি (পর্ব-৮)
jg
খারাপ। অসুখ যদিবেড়ে যায়, তা হলে?
তা হলে তোকে ডেকে পাঠাব। কিন্তু না ডেকে পাঠালে আর আসিস নে ভাই।
কেন মেজদি?
হেমাঙ্গিনী দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না, তোকে আর আমি এখানে আসতে দেব না। না ডেকে পাঠালেও যদি আসিস তা হলে ভারী রাগ করব।
কেষ্ট মুখপানে চাহিয়া সভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, তা হলে বল, কাল সকালে কখন ডেকে পাঠাবে?
কাল সকালেই আবারতোর আসা চাই?
কেষ্ট অপ্রতিভ হইয়া বলিল, আচ্ছা, সকালে না হয় দুপুরবেলায় আসবনা মেজদি? তাহার চোখেমুখে এমনই একটা ব্যাকুল অনুনয় ফুটিয়া উঠিল যে, হেমাঙ্গিনী মনে মনে ব্যথা পাইলেন। কিন্তু আর ত তাঁহার কঠিন না হইলে নয়। সবাই মিলিয়াএই নিরীহ একান্তঅসহায় বালকের উপর যে নির্যাতনশুরু করিয়াছে, কোন কারণেই আর ত তাহা বাড়াইয়া দেওয়া চলে না। সে হয়ত সহিতে পারে, মেজদির কাছে আসা-যাওয়া করিবার দন্ড যত গুরুতর হোক সে হয়ত সহ্য করিতে পিছাইবে না; কিন্তু, তাই বলিয়া তিনি নিজেকি করিয়া সহিবেন?
হেমাঙ্গিনীর চোখ ফাটিয়া জল আসিতে লাগিল; তথাপি তিনি মুখ ফিরাইয়া রুক্ষস্বরে বলিলেন, বিরক্ত করিস নে কেষ্ট, যা এখান থেকে। ডেকে পাঠালে আসিস, নইলে যখন তখন এসে আমাকে বিরক্ত করিস নে।
না বিরক্ত করিনিত, বলিয়া ভীত লজ্জিত মুখখানি হেঁট করিয়া তাড়াতাড়ি কেষ্ট উঠিয়া গেল।
এইবার হেমাঙ্গিনীর দুই চোখ বাহিয়া প্রস্রবণের মত জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। তিনি সুস্পষ্ট দেখিতে লাগিলেন,এই নিরুপায় অনাথছেলেটা মা হারাইয়া তাঁকেই মা বলিয়া আশ্রয় করিতেছে। তাঁহারই আঁচলের অল্প একটুখানি মাথায় টানিয়া লইবার জন্য কাঙালের মত কি করিয়াই না বেড়াইতেছে।
হেমাঙ্গিনী চোখ মুছিয়া মনেমনে বলিলেন, কেষ্ট, মুখখানি অমন করেগেলি ভাই, কিন্তু তোর এই মেজদি যে তোর চেয়েও নিরুপায়! তোকে জোর করে বুকে টেনে আনবে সে ক্ষমতা যে তার নেই ভাই।
উমা আসিয়া কহিল, মা, কাল কেষ্টমামা তাগাদায় না গিয়ে, তোমার কাছে এসে বসেছিলবলে জ্যাঠামহাশয় এমন মার মারলেন যে, নাক দি
হেমাঙ্গিনী ধমকিয়া উঠিলেনআচ্ছাহয়েচেহয়েচেযা তুই এখান থেকে।অকস্মাৎ ধমকানি খাইয়া উমা চমকাইয়া উঠিল। আর কোন কথা না কহিয়া ধীরে ধীরেচলিয়া যাইতেছিল;মা ডাকিয়া বলিলেন, শোন রে! নাক দিয়ে কি খুব রক্ত পড়েছিল?
উমা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, না খুব নয়, একটুখানি।
আচ্ছা তুই যা।
উমা কবাটের কাছেআসিয়াই বলিয়া উঠিল, মা, এই যে কেষ্টমামা দাঁডিয়ে রয়েচে।
কেষ্ট শুনিতে পাইল। বোধ করি ইহাকে অভ্যর্থনা মনে করিয়া মুখ বাড়াইয়া সলজ্জ হাসি হাসিয়া কহিল, কেমন আছ মেজদি?
ক্ষোভে দু:খে, অভিমানে হেমাঙ্গিনী ক্ষিপ্তবৎ চিৎকার করিয়া উঠিলেন,কেন এসেচিস এখানে? যা, যা বলচি শিগ্গির। দূর হ' বলচি
কেষ্ট মূঢ়ের মত ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল,হেমাঙ্গিনী অধিকতর তীক্ষ্ণ তীব্রকণ্ঠে বলিলেন, তবু দাঁড়িয়ে রইলি হতভাগাগেলিনে?
কেষ্ট মুখ নামাইয়া শুধু 'যাচ্ছি' বলিয়াই চলিয়া গেল। সে চলিয়া গেলে হেমাঙ্গিনী নির্জীবের মত বিছানার একধারে শুইয়া পড়িয়া অস্ফুটে ক্রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিলেন, এক শ'বার বলি হতভাগাকে, আসিস্ নে আমার কাছেতবু 'মেজদি'! শিবুকে বলে দিস ত উমা, ওকে না আর ঢুকতে দেয়।
উমা জবাব দিল না। ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।
রাত্রে হেমাঙ্গিনী স্বামীকে ডাকাইয়া আনিয়া কাঁদ-কাঁদ গলায় বলিল, কোনদিন ত তোমার কাছে কিছু চাইনিআজ এই অসুখের উপর একটা ভিক্ষা চাইচি, দেবে?
বিপিন সন্দিগ্ধ-কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, কি চাই?
হেমাঙ্গিনী বলিল, কেষ্টকে আমাকে দাওও বেচারী বড় দুঃখীমা-বাপ নেইওকে ওরা মেরে ফেলচে,এ আর আমি চোখে দেখতে পারচি নে।
বিপিন মৃদু হাসিয়া বলিলেন, তা হলে চোখ বুজে থাকলেই ত হয়।
স্বামীর এই নিষ্ঠুর বিদ্রূপ হেমাঙ্গিনীকে শূল দিয়া বিঁধিল, অন্য কোন অবস্থায় সে ইহা সহিতে পারিতনা, কিন্তু আজ নাকি তাহার দুঃখে প্রাণ বাহির হইতেছিল, তাই সহ্য করিয়া লইয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, তোমার দিব্যি করে বলচি, ওকে আমি পেটের ছেলেরমত ভালবেসেচি। দাও আমাকেমানুষ করিখাওয়াই-পরাইতার পরে যাইচ্ছে হয় তোমাদের তাই ক'রো। বড় হলে আমি একটি কথাও কবো না।
বিপিন একটুখানি নরম হইয়া বলিলেন, ও কি আমার গোলার ধান-চাল যে তোমাকে এনে দেব? পরের ভাই, পরের বাড়ি এসেচেতোমার মাঝখানেপড়ে এত দরদ কিসের জন্যে?
হেমাঙ্গিনী কাঁদিয়া ফেলিল। খানিক পরে চোখ মুছিয়া বলিল, তুমি ইচ্ছে করলেবঠ্ঠাকুরকে বলে, দিদিকে বলে, স্বচ্ছন্দে আনতে পার। তোমার দুটি পায়ে পড়চি, দাও তাকে।
বিপিন বলিলেন, আচ্ছা, তাই যদি হয়, আমিই বা এত বড়মানুষ কিসে যে, তাকে প্রতিপালন করব?
হেমাঙ্গিনী বলিল, তুমি আগে আমার একটা তুচ্ছকথাও ঠেলতে না, এখন কি অপরাধ করেচি যে, যখন এমন করে জানাচ্ছি,বলচি,সত্যিই আমার প্রাণ বার হয়ে যাচ্চেতবু এই সামান্য কথাটা রাখতে চাইচ না? সে দুর্ভাগা বলেকি তোমরা সকলে মিলে তাকে মেরে ফেলবে? আমি তাকে আমার কাছে আসতে বলব, দেখি ওঁরা কি করেন।
বিপিন এবার রুষ্ট হইলেন। বলিলেন, আমি খাওয়াতে পারব না।
হেমাঙ্গিনী কহিল, আমি পারব। আমি কি বাড়ির কেউ নই যে, নিজের ছেলেকে খাওয়াতে পারব না। আমি কালই তাকে আমার কাছে এনে রাখব। দিদিরা জোর করেনত আমি তাকে থানায় দারোগার কাছে পাঠিয়ে দেব।
স্ত্রীর কথা শুনিয়া বিপিন ক্রোধে অভিমানে ক্ষণকাল অবাক হইয়া থাকিয়া বলিলেন, আচ্ছা, সে দেখা যাবে, বলিয়া বাহির হইয়া গেলেন।
পরদিন প্রভাত হইতেই বৃষ্টি পড়িতেছিল, হেমাঙ্গিনী জানালাটা খুলিয়া দিয়া আকাশের পানে চাহিয়াছিলেন, সহসা পাঁচুগোপালের উচ্চ কণ্ঠস্বর কানে গেল। সে চেঁচাইয়া বলিতেছিল, মা, তোমার গুণধর ভাইজলে ভিজতে ভিজতেএসে হাজির হয়েচে।
খ্যাংরা কোথায় রে? যাচ্ছি আমি, বলিয়া কাদম্বিনী হুঙ্কার দিয়া ঘরহইতে বাহির হইয়ামাথায় গমছা দিয়াদ্রুতপদে সদর-বাড়িতে ছুটিয়া গেলেন।
হেমাঙ্গিনীর বুকটা যেন কাঁপিয়া উঠিল। ললিতকে ডাকিয়া বলিলেন, যা ত বাবা, ও-বাড়ির সদরে। দেখত, তোর কেষ্টমামা কোথা থেকে এল?
ললিত ছুটিয়া চলিয়া গেল এবং খানিক পরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, পাঁচুদা তাকে নাডুগোপাল করে মাথায় দুটো থান ইট দিয়ে বসিয়ে রেখেচে।
হেমাঙ্গিনী শুষ্কমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি করেছিল সে?
ললিত বলিল, কাল দুপুরবেলা তাকে তাগাদা করতে পাঠিয়েছিল গয়লাদের কাছে,
Created at 2012-11-20 23:31
Back to posts